Tanni for Danceof Chaos
আমার ঠাম্মা পারেনা এমন কোন কাজ নেই।
সেই কোন যুগে, 1963 সালে স্নাতকোত্তর মানে মাস্টার্স করে ফেলেছিল। তারপর চারপাশের লোকেদের ব্যাঁকা কথা, চোখ টাটান উপেক্ষা করে সংসারের হাল ধরতে চাকরি। ঠাম্মা খুব অল্প বয়সে বিধবা।তাই লোকেদের কথা আরও হত।কিন্ত শ্বাশুড়ী আর শ্বশুরবাড়ীর আশীর্বাদে ঠাম্মা নির্ভয়ে যেত হাইস্কুলে পড়াতে।
কালের নিয়মে ঠাম্মা অবসর নিল। তথন পড়া আর পড়ানোর পাশাপাশি মোটামুটি সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে। যেখানে যেত, শিক্ষিকা শুনলেই লোকে অসম্ভব সম্মান করত। সরুপাড়ের থান, সাধারন করে পড়া, চোখে চশমা, ব্যক্তিত্বময়ী যখন নরম অথচ দৃঢ় স্বরে কথা বলতেন, সে বাংলা, ইংলিশ অথবা ভাঙা হিন্দীতে, অতি দুর্বিনীত ও নত হত।
আমি সেই 2008 থেকে শিক্ষাসূত্রে জর্মনীতে আছি। চাকরি শুরুর পর থেকেই ইচ্ছা, একবার ঠাম্মা আসুক আমার কাছে। কিন্তু পাসপোর্ট নেই, ভিসার মুশকিল এই করে করে ঠাম্মা কাটায়। ট্রেন, প্লেনে চড়ে কলকাতা দিল্লী করত বোনের কাছে, বাইরে আসার সাহস পেত না।
2017 সালে আমি ধরে পড়লাম, আসতেই হবে। কান্নাকাটি, অভিমান, অশান্তির পর পাসপোর্ট করানোর অনুমতি মিলল। আমার বোন লেগে গেল কাজে। আমার এটা নেই, ওটা নেই করতে করতে সব গিঁট খুলতে লাগল আর পাসপোর্ট হয়ে গেল। আমি এখান থেকে Verpflichtungserklärung পাঠিয়ে দিলাম। ওমা আসবেন ইন্ডিয়েন থেকে শুনে ওনারাও আহ্লাদে আটখানা।
শেষ কাজ ভিসা। ভয়ে ভয়ে মা আর বাবা নিয়ে গেল ভি.ফ.স অফিসে, ঊনআশী বয়স, যদি না করে দেয়? দু দিনের মাথায় ভিসা দি়য়ে ওনারা বললেন, যান ঘুরে আসুন নাতনীর কাছ থেকে।
প্রায় আশির কাছাকাছি, প্রথম বিদেশ যাত্রা। পাড়া-পড়সী, ভাইপো, ভাইঝি সবাই খুব উত্সাহিত। বাবা মা একবার আনন্দ করছে, একবার ওষুধ গোছাচ্ছে, একবার আমাকে ফেসটাইমে, অনেক দায়িত্ব তোর, ঠাম্মাকে যত্নে রাখবি, এটা করবি না, ওটা বলবিনা করছে।
যথা দিনে ঠাম্মা হুইল চেয়ারে বসে টাটা করতে করতে প্লেনে উঠে পড়ল। আমরা সবাই মিলে তো সারারাত জেগে আছি। ঠাম্মা স্মার্টফোন নেবে না, পুরোনো নোকিয়া ভরসা খালি। দুবাইতে হুইল চেয়ার, লাউন্জ, কস্সিয়ার্জ সারভিস সব বুক করে ফেলেছি, তাও চিন্তা তো হয়।
মাঝরাতে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। এক জর্মন ভদ্রমহিলার গলা। ঠাম্মা দিব্যি প্লেনে বন্ধুত্ব পাতিয়ে সব ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সবাই মিলে ওনারা সব ডেকে দিয়েছেন, বোর্ডিং ও হয়ে গেছে নির্বিগ্ঘ্নে, আবার ওনাদের বলেছে আঈ. এস. ডি না করে ফেসটাইম করে আমাকে জানাতে, যাতে কারুর অকারণে খরচ না হয়।
ফ্রাঙ্কফুর্টে অপেক্ষা করছি। দূর থেকে শুনতে পেলাম, My granddaughter Tannistha , সেই আদরের গলায়। হুইল চেয়ারে বসে চালিকাকে দুইহাত তুলে আশীর্বাদ করে ঠাম্মা বেড়িয়ে এল, কাঁধের ব্যাগে নেলকাটার আর পেনক্নাইফ নিয়ে। সবাই, নাতনীর কাছে আনন্দ করুন, বলে বিনা বাধায় ছেড়ে দিয়েছেন।
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে তিন ঘন্টা গাড়ী চালিয়ে নিয়ে এলাম। ঘরে পা রেখেই, এটা, ওটা গুছিয়ে দেব বলে ঢেঁকি ধান ভানতে লেগে গেল, কোন ক্লান্তি নেই।
এক মাস ছিল ঠাম্মা এখানে। আমার সব ইচ্ছা পূর্ণ করে ঘুরেছিলাম। ক্রসকান্ত্রি রোডট্রিপ। গাড়ী চালাচ্ছি আমি, পাশে বসে হাত টিপে দিচ্ছে ঠাম্মা।
আমার ওগো শুনছোর সাথে নব্য প্রেম, তাকে বাড়ীতে ডেকে খাইয়ে দাইয়ে রীতিমত ইন্টারভিউ নিয়েছিল ঠাম্মা। সে গল্প পরের বারের জন্য তোলা রইল।
একবছর হল ঠাম্মা আমাদের সবাইকে টাটা করে চলে গেছে। শে়ষ অবধি আমাদের দুইবোনের পুজোর লেখার প্রুফরীড করে দিয়েছিল।
ন হন্যতে, হন্যমানে শরীর।
যখন মন কেমন করে, চোখ বন্ধ করে ঠাম্মাকে ভাবি, মনে পড়ে যায় ফ্রাঙ্কফুর্টে হুইল চেয়ার চালিকার কথা:
“ তুমি তন্নিষ্ঠা? তুমি যান তুমি কত ভাগ্যবতী? এতটা পথ একা এসেছেন, মুখে শুধু তোমার নাম। ইমিগ্রেসনে সবাইকে তোমার নাম বলেছেন। এত ভালবাসা কোথাও পাবে না, খুব যত্নে রাখবে যে কদিন এখানে থাকবেন।
[ Du bist Tannistha? Du weiß nicht, wie glücklich du bist! Sie hat alleine hierhin geflogen nur für dich und nicht anders als dein Name ausgesprochen und dich gelobt. Wir waren alle so sehr beeindruckt. Pass sehr gut auf deine liebe Oma]
ঠাম্মা তুমি উপর থেকে আমাদের আদর কর।
[ Part of my Puja 2021 Tribute to Thamma. Also published in Iccedana2021, Durgapuja Franken Sharod Sankalan and in momspresso]